মেয়েদের অতি পরিচিত একটি রোগ
পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম (পিসিওএস) হরমোনজনিত একটি রোগ যা প্রজননকালীন বয়সের মহিলাদের মধ্যে খুবই সাধারণ। রোগাক্রান্ত মেয়েদের অনিয়মিত, কম সময় বা দীর্ঘমেয়াদি ঋতুস্রাব হতে পারে। ‘পলি’ শব্দের অর্থ ‘অনেক’। আর সহজভাবে বলতে গেলে সিস্ট শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘তরলে পূর্ণ থলি’। এ রোগে ওভারিতে অনেকগুলো ছোট ছোট তরলে পূর্ণ থলির সৃষ্টি হতে পারে যে কারণে ওভারি থেকে ডিম্বাণু নির্গত হতে পারে না।
লক্ষণ-
সাধারণত বয়ঃসন্ধিকালে প্রথম ঋতুস্রাবের সময়েই উপসর্গ দেখা দিতে পারে। মাঝেমাঝে শরীরের ওজন যথেষ্ট বৃদ্ধির জন্য দেরিতেও এই রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়। ১৭২১ সালে ইতালির চিকিৎসক এন্টোনিও ভ্যালিশনেরি সর্বপ্রথম এই রোগের লক্ষণ বর্ণনা করেছিলেন। রোগের লক্ষণ বিভিন্ন রকম হতে পারে :
ক। অনিয়মিত মাসিক : পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোমের সর্বজনীন লক্ষণ হিসেবে কদাচিৎ, অনিয়মিত ও দীর্ঘ সময় অন্তর অন্তর মাসিক হয়। সাধারণত বছরে ৮-৯ বারের কম মাসিক হয়। খ। পুরুষ হরমোন বৃদ্ধি : পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোমে আক্রান্ত রোগীদের পুরুষ হরমোন এন্ড্রোজেন বেশি থাকে। এই হরমোনের প্রভাবে কিছু শারীরিক লক্ষণ যেমন– মুখ ও শরীরে লোম গজায় যাকে হির্সুটিজম বলে। শতকরা ৭০ ভাগ রোগীর এই লক্ষণ প্রকাশ পায়। এছাড়াও ব্রণ এবং পুরুষদের মতো টাক হয়। গ। পলিসিস্টিক ওভারি : ওভারি বড় হয়ে যায় ও ডিম্বাণুকে ঘিরে ফলিকল বা গুটির মতো বস্তুর সৃষ্টি হয়। ঘ। প্রচুর রক্তপাত : এ রোগ হলে জরায়ুর আস্তরণ গঠিত হতে অনেক সময় নেয়। ফলে মাসিকের সময় প্রচুর রক্তপাত হতে পারে।
কারণ-
চিকিৎসকরা এই রোগের সঠিক কারণ এখনো জানতে পারেনি। তবে যে সকল কারণে এ রোগ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি হয় সেগুলো হচ্ছে–
অতিরিক্ত ইনসুলিন : শরীরে অতিরিক্ত ইনসুলিন তৈরি হলে তা এন্ড্রোজেন হরমোনের উৎপাদন বৃদ্ধি করে। ফলে ওভুলেশন বা ডিম্বস্ফোটন ব্যাহত হয়। মোটা শরীর বা অতিরিক্ত ওজনের মেয়েদের কোষগুলো যথাযথভাবে ইনসুলিন ব্যবহার করতে না পারায় এদের ক্ষেত্রে এই রোগের সম্ভাবনা বেশি হয়। জানা যায়, এ রোগাক্রান্ত শতকরা ৮০ ভাগ মেয়েদের অতিরিক্ত ওজন থাকে।
প্রদাহ : গবেষণায় দেখা গেছে যে, আক্রান্ত মহিলাদের মধ্যে এক ধরনের নিম্নমানের প্রদাহ থাকে যা পলিসিস্টিক ওভারিকে এন্ড্রোজেন উত্পাদনে উদ্দীপিত করে। এই প্রদাহ আবার অতিরিক্ত ওজনের মেয়েদের বেশি থাকে।
বংশগত : বংশগতভাবে নির্দিষ্ট কোনো জিন এই রোগ সৃষ্টির সাথে জড়িত থাকতে পারে বলে গবেষকরা ধারণা করেন।
অতিরিক্ত এন্ড্রোজেন : সাধারণত মেয়েদেরও ওভারি থেকে পুরুষ এন্ড্রোজেন নির্গত হয়। কিন্তু কোনো কারণে যদি ওভারি থেকে অতিরিক্ত এন্ড্রোজেন হরমোন নির্গত হয় তবে এই রোগ হতে পারে।
জটিলতা-
পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোমে আক্রান্ত মহিলাদের নিম্নোক্ত জটিলতাগুলো হতে পারে-
• বন্ধ্যাত্ব হওয়া। যাদের নিয়মিত ডিম্বস্ফোটন হয় না তাদের নিষিক্তকরণের জন্য পর্যাপ্ত ডিম্বাণু উৎপন্ন হয় না। পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম রোগ বন্ধ্যাত্বের অন্যতম কারণ। • গর্ভকালীন ডায়াবেটিস অথবা গর্ভজনিত কারণে উচ্চ রক্তচাপ হয়। • গর্ভপাত বা নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বেই সন্তান ভূমিষ্ট হতে পারে। • কলিজায় অতিরিক্ত চর্বি জমে ‘ফ্যাটি লিভার সিন্ড্রোম’ হতে পারে। • বিপাকীয় লক্ষণ যেমন– অতিরিক্ত রক্তচাপ, রক্তে শর্করার পরিমাণ বৃদ্ধি, কোলেস্টেরল বা ট্রাইগ্লিসারাইডের পরিমাণ বেড়ে যায়। ফলে হৃদরোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। • টাইপ-২ ডায়াবেটিস হয়। • ঘুমের সময় শ্বাস-প্রশ্বাসে ব্যাঘাত ঘটে। • বিষণ্ণতা, দুশ্চিন্তা এবং খাদ্যাভাসে পরিবর্তন আসা। খাদ্যাভাসে পরিবর্তন হওয়া বলতে অতিরিক্ত খাবার গ্রহণই নয়, হতে পারে খাবার গ্রহণে অনীহাও। • জরায়ু থেকে অস্বাভাবিক রক্তপাত। • জরায়ুর এন্ড্রোমেট্রিয়ামে ক্যানসারও হতে পারে।
রোগ সনাক্তকরণ-
চিকিৎসকরা সাধারণত রোগের লক্ষণ, রক্ত পরীক্ষা, জননাঙ্গে আঙ্গুল দিয়ে পরীক্ষা, আল্ট্রাসাউন্ড ইত্যাদির মাধ্যমে রোগ সনাক্ত করেন।
রোগ প্রতিরোধ-
রোগ প্রতিরোধের জন্য নিয়মিত ব্যায়াম, জীবনধারার পরিবর্তন ও সুষম খাবার গ্রহণ করতে হবে। নিয়মিত ফলমূল, শাকসবজি ও দানাদার খাদ্য খেতে হবে।
চিকিৎসা-
জন্মনিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যবহৃত বড়ি মাসিকচক্রকে নিয়মিতকরণ করতে পারে। ক্লোমিফেন জাতীয় ওষুধ এ রোগাক্রান্তদের গর্ভবতী করতে পারে। লোমনাশক ক্রিম ব্যবহার করা যেতে পারে। যদি কোনো চিকিৎসায় কাজ না হয় তবে সার্জারি করা হয়। চিকিৎসার পর সুস্থ মা সন্তান জন্মদানে সক্ষম হতে পারে।
কোনো রোগই লজ্জার নয়। শরীরে লোম গজানো, অতিরিক্ত মোটা হয়ে যাওয়া, নিয়মিত মাসিক না হওয়া ইত্যাদির অন্তরালে হয়তো লুকিয়ে থাকতে পারে মারাত্মক রোগ। তাই এমন লক্ষণ বুঝতে পারলে লজ্জিত না হয়ে দ্রুত পরিবারকে জানিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
No comments: