OMG !!! মানুষের তৃপ্তি বাড়ায় না, বরং কমিয়ে দেয়
অনেকে মনে করেন পর্নোগ্রাফী মানুষের যৌন উত্তেজনা বাড়ায় অথচ বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে পর্নের সাথে স্বাভাবিক ও প্রকৃত যৌনতার দূর থেকেও কোনো সম্পর্ক নেই। এটা অনেকের অবিশ্বাস্য মনে হলেও এটাই সত্য যে পর্নের সাথে যৌনতার কোন সম্পর্কই নেই। বরং পর্ন হল একধরণের পন্য যার খরিদদার হল পর্ন আসক্তরা।
এছাড়াও বিভিন্ন গবেষণায় এও দেখা গেছে যে যৌন উত্তেজনা, যৌন আকর্ষণ ও যৌন ক্ষমতা হ্রাসের জন্য অনেক ক্ষেত্রে পর্নোগ্রাফী সরাসরি দায়ী। পর্নোগ্রাফী জীবন সঙ্গীর মাঝে যৌন তৃপ্তি হ্রাস করে ফেলে এবং অকাল বীর্যপাত, যৌন জটিলতা ও সঙ্গমের স্থায়িত্ব কমিয়ে দেওয়ার পেছনে পর্নোগ্রাফী অনেক ক্ষেত্রে দায়ী বলে মনে করেন গবেষকরা।
পর্নে যারা আসক্ত তাদের যৌন জীবন এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে পর্নোগ্রাফী না দেখলে তারা স্বাভাবিকভাবে উত্তেজিতই হয়না, শুধু স্বাভাবিক উত্তেজিত হয়না তা নয় বরং তারা স্ত্রী সঙ্গমের সময়েও উত্তেজিত অনুভব করেনা। একবার বেশ কিছু সিনিয়র হাইস্কুল ছাত্রদের মাঝে সমীক্ষা চালানো হয় তাতে দেখা যায় পর্ন দেখার ফলে তাদের স্বাভাবিক যৌন আকাঙ্খা অস্বাভাবিকভাবে কমে গেছে। কম বয়সী যুবকদের মাঝে যৌন স্থায়ীত্ব কমে যাওয়াতেই বোঝা যায় পর্নের সাথে যৌনতা বৃদ্ধির কোন সম্পর্ক নেই। যদি তাই হত তাহলে যারা যৌন সমস্যায় ভুগছেন তাঁদেরকে উক্ত সমস্যা থেকে মুক্তি পাবার জন্য পর্নোগ্রাফী দেখার উপদেশ দিতেন যৌন চিকিৎসকেরা, কিন্তু পর্নোগ্রাফী যৌন সমস্যাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে এবং যৌন তৃপ্তি কমিয়ে দিচ্ছে অস্বাভাবিকভাবে। আজ থেকে তিরিশ বছর আগেও ৩৫ বছরের কম বয়সী পুরুষদের মধ্যে ইরেক্টাইল ডিসফাংশন (erectile dysfunction) এর কথা শোনা যেত না; এই সমস্যা হত শুধুমাত্র বৃদ্ধদের মধ্যে। কিন্তু বর্তমানে পর্নোগ্রাফির সহজলভ্যতার কারণে এমন পরিস্থিতি হয়েছে যে, ১৬ বছরের অনেক যুবকের মাঝেও আজকাল ইরেক্টাল ডিসফাংশনের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। বার বার পর্ন দেখার ফলে মানুষেরমস্তিষ্কের গঠন এমন হয়ে যায় যে, যৌন চাহিদা পর্নের ওপর নির্ভরশীল হয়ে যেতে থাকে। ফলে একজন পর্ন আসক্ত ব্যক্তি অনেক সময় তার সঙ্গীর সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক উত্তেজনা অনুভব করে না। আসক্তি বাড়ার সাথে সাথে অন্য আসক্তিকর নেশাজাতীয় পদার্থের মতোই পূর্বে দেখা পর্নগুলো আর তাকে সেভাবে উত্তেজিত করতে পারে না। কারণ তার মস্তিষ্কের ডোপামিন রিসেপ্টরগুলো (dopamine receptors) নিষ্ক্রিয় হতে থাকে। এই অবস্থায় একজন পর্নোগ্রাফী আসক্ত ব্যক্তি আগের উত্তেজনা ফিরে পাবার জন্য আরও এক্সট্রিম লেবেলের পর্নের দিকে ঝুঁকতে থাকে। আসলে নীল পর্দায় প্রদর্শিত বিকৃত ও হিংসাত্মক যৌনতার স্বাদ উপভোগকারী পর্ন আসক্ত ব্যক্তিগুলো তাদের সঙ্গীর প্রতি স্বাভাবিক আকর্ষণ হারিয়ে ফেলতে থাকে। ইন্টারনেটের ভার্চুয়াল ও মেকি যৌনতা বাস্তব জীবনে যৌনতার এর ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়।
গবেষণায় দেখা গেছে, যারা নিয়মিত পর্ন ভিডিও দেখেন তাদের মস্তিষ্কের আকার ধীরে ধীরে সাধারণ পুরুষদের মস্তিষ্কের চেয়ে ছোট হয়ে যায়। জার্মান সাইকিয়াট্রি জার্নালে এক স্টাডির রিপোর্টে এ তথ্য জানানো হয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যারা পর্ন দেখে তাদের মস্তিষ্কের আকার সাধারণ মানুষের তুলনায় অনেক ছোট হয়ে যায়। এই তথ্য জার্মান সাইকিয়াট্রি জার্নালে এক স্টাডির রিপোর্টে প্রকাশ করা হয়।
চিকিৎসকগণ তাঁদের সাধারণ পুরুষদের মস্তিষ্কের সাথে পর্নোগ্রাফী দেখতে অভ্যস্ত এমন পুরুষদের মস্তিষ্কের তুলনা করে এমন রিপোর্ট পেশ করেছেন। গবেষকদের মত অনুযায়ী, ষ্ট্রিয়াটোম নামের এক ধরণের সেনসিটিভ বিকল্প থিওরী পর্নোগ্রাফিতে আসক্তি সৃষ্টি করে। এটিই মূলত পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত ওই সকল পুরুষদের মস্তিষ্কের আকারে পরিবর্তন এনে থাকে। বার্লিনে অবস্থিত ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনিষ্টিটিউটের ড. সাইমন কোহন তাঁর অনুসারীরা জার্মানির চারিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদল প্রায় ৬৪ জন সুস্থ ও সুঠাম দেহের পুরুষ যাদের বয়স ২১ থেকে ৪৫ বছরের এর মধ্যে, তাদের উপর গবেষণা করে প্রাথমিক তথ্যে উপনীত হয়েছেন, তাঁরা পর্যবেক্ষন করেছেন, সুস্থ ও সুঠাম দেহের পুরুষদের মস্তিষ্কের তুলনায় যারা পর্নগ্রাফীতে আসক্ত, তাদের মস্তিষ্কের আকার ছোট হয়ে আসে। (সূত্রঃ সময় নিউজ, ১৭ জুলাই ২০১৮ সংখ্যা, অনলাইন সংস্করণ)
এছাড়াও পর্নে দেখা যায় এই ছবির নায়িকারা পুরুষের বীর্য পান করে থাকে। অথচ যার বীর্য পান করা হচ্ছে তার যদি যৌন রোগ থাকে তাহলে সেই রোগ নায়িকার শরীরে প্রবেশ করতে পারে এমনকি মুখে ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে। সেজন্য আজকাল বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় দেখা যায় বিশ্বের নামী দামী সিনেমা ও পর্ন স্টাররা এসব করতে গিয়ে একসময় মুখের নানা প্রকার মারাত্মক সব ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছে। এছাড়াও বীর্য পানের মাধ্যমে সহজেই এবং দ্রুত STD বা যৌন-সংক্রান্ত ভাইরাস ছড়ায়। কারণ, এতে বীর্য সরাসরি পেটে যায়। তারপর সেখান থেকে সরাসরি রক্তকণিকায়।
বীর্য হল একপ্রকার অপবিত্র পানীয় যা ধর্মীয় ভাবেও নিষিদ্ধ। মানুষ হল রুচিশীল জীব তাই বীর্য পান করা এক ধরণের বিকৃত মানসিকতার পরিচয়। ডাক্তারদের মতে বীর্যে মূলত প্রোটিন থাকে কিন্তু তার পরিমাণ এতটাও অল্প যে তাতে শরীরের কোন উপকারই হয়না।
আর পর্নের নায়িকারা পুরুষের বীর্যপান ইচ্ছাকৃতভাবে করে না, আসলে তারা তাদের অভিনীত পর্ন মুভিটিকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য এসব করে থাকে। বর্তমান প্রতিযোগিতার মার্কেটে যার ভিডিওতে যত পরিমাণ বিকৃত যৌনতা থাকবে তার মুভি মার্কেটে তত বেশি হিট হবে। সুতরাং নিছক এক ব্যবসায়িক মানসিকতা নিয়েই উক্ত পর্ন অভিনেত্রীরা পুরুষের বীর্য পান করে থাকে। অনেক সময় দেখা যায় একজন পর্ন আসক্ত ব্যক্তিও এসব বিকৃত যৌনতা দেখে তার বাস্তব সঙ্গীকেও বীর্য পানের জোর দিতে থাকে ফলে সংসারে নেমে আসে অশান্তি। ক্রমে একসময় এসব বিকৃত যৌনতা বিবাহ বিচ্ছেদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
স্নায়ুবিজ্ঞানী ডঃ নরম্যান ডয়জ The Brain That Changes Itself নামে একটি বই লিখেছেন। তিনি বলেন, “আজ থেকে ত্রিশ বছর আগে হার্ডকোর পর্ন বলতে যা বোঝানো হতো যাতে সঙ্গমের দৃশ্য একদম স্পষ্ট করে দেখানো হতো। তবে এখন হার্ডকোর পর্নে পরিবর্তন হয়েছে। এখন হার্ডকোর পর্ন নৃশংস আর বিকৃত যৌনাচারে ভরপুর। এগুলোতে যৌন মিলনকে শুধুমাত্র নিজের লালসা পূরণ আর জীবন সঙ্গীর প্রতি আক্রোশ আর কষ্ট দেওয়ার মাধ্যম হিসেবে দেখানো হয়। বর্তমানে পর্নোগ্রাফী মানুষকে হীন আর অপমানিত করে এতটা নিচে নামানো হয় যা এর আগে মিডিয়ায় আগে কখনও কেউ দেখেনি।”
তিন আরও বলেন, ‘কয়েক দশক আগে যা ছিল হার্ডকোর পর্ন বলে বিবেচিত ছিল এখন তা সফটকোর। তখনকার দিনের সফটকোর ক্যটাগরির পর্ন ছবিগুলো এখনকার দিনে টেলিভিশনের পর্দায় দর্শকদের যৌন সুরসুরি দেওয়ার জন্য নাচ-গান, মুভি-সিরিয়াল, পণ্যের বিজ্ঞাপনে প্রদর্শিত হচ্ছে।”
১৯৪৮ সালে বিজ্ঞানী ও লেখক ডা: আলফ্রেড কিনসে সেক্স নিয়ে খুব জনপ্রিয় একটি বই লিখেছিলেন। তিনিই প্রথম বিজ্ঞানী ও লেখক যিনি যৌনতা নিয়ে তাঁর খোলাখুলিভাবে আলোচনা করেছিলেন। ফলে তাঁর বইয়ে বিক্রি অবিশ্বাস্য ভাবে বেড়ে যায়। বাজারে মুড়ি মুড়কির মত তাঁর বই বিক্রি হতে থাকে। এর আরও পাঁচ বছর পর অর্থাৎ ১৯৫৩ সালে হিউ হেফনার তাঁর বাড়ির রান্নাঘর থেকে প্লেবয় ম্যাগাজিনের প্রথম সংখ্যা প্রকাশ করেন। ততদিনে আমেরিকার সংস্কৃতিতে যৌনতা বিশেষ স্থান দখল করে ফেলেছে। তিনি এই ম্যাগাজিন বের করার জন্য ৮ হাজার মার্কিন ডলার ধারন করেন এবং তাঁর মাও তাঁকে ১ হাজার ডলার দিয়ে সাহায্য করেন। প্লেবয়- ম্যাগাজিনের প্রথম সংখ্যা থেকে তারিখ সরিয়ে নেয়া হয়, যদি সময়ের মধ্যে ম্যাগাজিন বিক্রি না হয় এই আশঙ্কায়। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে প্রথম প্রকাশের কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই এটির ৫০ হাজারেরও বেশি কপি বিক্রি হয়ে যায়। এবং এই ম্যাগাজিনটি যখন সাফল্যের শীর্ষস্থানে ছিল তখন প্রতি মাসে এটি সর্বোচ্চ ৭০ লাখ কপি পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে। যৌনতার সুড়সুড়ি দিয়ে এই ম্যাগাজিনের মাধ্যমে হেফনার টাকা কামানোর এক বিরাট সুযোগ পেয়ে গেলেন। ম্যাগাজিনের বিক্রি বাড়ানোর জন্য তিনি নতুন নতুন চোখ ধাঁধানো বিজ্ঞাপন দিতে শুরু করলেন। বিভিন্ন লেখকের লেখার পাশাপাশি পর্নোগ্রাফিক ছবিই এই ম্যাগাজিনের মূল আকর্ষণের বিষয়বস্তু হয়ে উঠল। তবে তখন এই পত্রিকার গ্রাহকরা পর্নোগ্রাফিকে শুধুমাত্র বিনোদন হিসেবেই উপভোগ করেছিলেন।
আমেরিকান সংস্কৃতিতে যৌনতার এ প্রভাবকে টাকা কামানোর সুযোগ হিসেবে হেফনার কাজে লাগালো। তার ম্যাগাজিনের বিক্রি বাড়ানোর জন্য নতুন নতুন চোখ ধাঁধানো সব ছবি বিজ্ঞাপনে ও পত্রিকায় দিতে শুরু করল। বিভিন্ন লেখকের লেখার পাশের পর্নোগ্রাফিক ছবিই ম্যাগাজিনের মূল আকর্ষণ হয়ে উঠল। প্লেবয় ম্যাগাজিনের ক্ষেত্রে পর্নোগ্রাফী নিছকই নির্দোষ বিনোদন হিসেবে মেনে সবাই উপভোগ করতে লাগল।
হিউ হেফনারের প্রকাশিত আন্তর্জাতিক এই যৌনতা সংক্রান্ত ম্যাগাজিনটি অনেকের কাছে ‘অশ্লীল’ বা নোংরা মনে হলেও, অনেকে মনে করেন এই ম্যাগাজিনটি যৌন বিপ্লবের অগ্রদূত। হিউ হেফনার ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর নামে ৯১ বছর বয়সে স্বাভাবিকভাবে মৃত্যুবরণ করেন। (সূত্রঃ বিবিসি, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭, অনলাইন সংস্করণ)
দুই
মনে করুন ১৯৮০ সালের গোড়ার দিকের কথা। তখন মানুষ ঘরে বসে মুভি দেখত। তখন অনেকেই দোকান থেকে ক্যাসেট কিনে এনে ঘরে বসে ভিসিআরের মাধ্যমে পর্নোগ্রাফী দেখত। ইন্টারনেটে পর্ন দেখা শুরু হয় ১৯৯০ সাল থেকে। তখন যাদের ইন্টারনেট কানেকশন ও ভিডিও দেখার প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ছিল তারা সহজেই ঘরে বসে পর্নোগ্রাফীর স্বাদ উপভোগ করতে পারতো। তবে ইন্টারনেট পর্নোগ্রাফীর ইতিহাসের গতিপথ একেবারেই পালটে দিল ১৯৯০ সালের প্রথম দিকে। অনলাইনে পর্ন ইন্ডাস্ট্রির প্রসার এতই বেড়ে গেল যে ১৯৯৮ থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে পর্নোগ্রাফীর ওয়েবসাইটের বৃদ্ধির পরিমাণ ছিল ১৮০০%। এরপর ক্রমাগত এই ইন্ডাস্ট্রির প্রসার বাড়তেই লাগল। ইন্টারনেটে থাকা মোট তথ্যের ৩০% ই দখল করে নিল পর্ন ইন্ডাস্ট্রি। শুনতে অবাক লাগলেই এটা সত্য যে মাইক্রোসফট, গুগল, ইয়াহু, অ্যামাজন, ই-বে, অ্যাপল, নেটফ্লিক্স, আর্থলিংকের মিলিত আয়ের কয়েকগুণ বেশী আয় হল এই পর্ন ইন্ডাস্ট্রির আয়। মানুষের আসক্তি পর্নোগ্রাফীর প্রতি বাড়তেই লাগল, ফলে তৈরি হতে থাকল আরও উগ্র এবং হার্ডকোর ও এক্সট্রীম লেবেলের পর্ন। ইন্টারনেটে পর্নোগ্রাফীর বৃদ্ধির সাথে তাল মিলিয়ে এই ইন্ডাস্ট্রির অন্ধকার জগত আরও অন্ধকার হতে অন্ধকারাচ্ছন্ন হতে থাকল।
ইন্টারনেটের জনপ্রিয় ওয়েবসাইট নেটফ্লিক্স, অ্যামাজন এবং টুইটার, ফেসবুক প্রভৃতি ওয়েবসাইটে প্রতি মাসে মোট যে পরিমাণ মানুষ ভিজিট করে, তার চেয়েও পর্ন সাইটগুলোর ভিজিটর অনেক বেশী। অবাক করা তথ্য হল যে শতকরা ৭০ জন পুরুষ এবং ৩০ জন নারী নিয়মিত পর্ন দেখে; বাচ্চারা অতি অল্প বয়সে অর্থাৎ গড় ১১ বছর বয়সে পর্ন খুঁজে পাচ্ছে। ৯ থেকে ১২ বছরের অনেক বাচ্চারা এখন নিয়মিত পর্নের দুনিয়ায় বিচরণ করছে। অথচ এসব নিয়ে আমাদের সমাজে কোন হেলদোল নেই।
একটা সময় ছিল যখন পর্নোগ্রাফী দেখার জন্য অনেক কাটখড় পোড়াতে হত। সময় বের করে কোন নির্জন বাড়িতে ক্যাসেট কিনে এনে দেখতে হত। কিন্তু এখন সময় পাল্টেছে। স্মার্টফোনের মত ছোট্ট একটা ডিভাইস হাতে থাকলেই যে কোন মুহূর্তে পর্নোগ্রাফীর স্বাদ উপভোগ করা যায়। একটি ক্লিকেই হাজার হাজার পর্নের দৃশ্য আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। পর্নোগ্রাফীকে এখন এতটাই স্বাভাবিক করতে সক্ষম হয়েছে যে পর্নস্টারদের তাদের পারফরমেন্সের জন্য পুরস্কৃতও করা হচ্ছে। এমনকি পর্ন ইন্ডাস্ট্রি সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য কলম্বিয়াতে ইউনিভার্সিটিও প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সুতরাং বোঝায় যাচ্ছে সমাজ, পরিবার থেকে শুরু করে কর্মক্ষেত্রসহ সর্বত্র পর্নোগ্রাফীর প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছে।
আজকে প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলারের পর্ন ইন্ডাস্ট্রি প্রতিনিয়তই বিস্তৃত হচ্ছে এবং নিত্য নতুন দর্শক সংখ্যাও বাড়াচ্ছে। মনে করুন একটা সময় ছিল যখন লোকেরা চটি গল্পের বইগুলো ঘরের বিভিন্ন গোপন স্থানে লুকিয়ে রাখত। আর এখন বর্তমান ডিজিটাল যুগে সেই লোকগুলোই সার্চ করা পর্নের হিস্ট্রিগুলি ব্রাউজারের হিস্ট্রি থেকে ডিলিট করে ফেলে বা লুকিয়ে ফেলে, অথবা পোর্টেবল হার্ডড্রাইভে শত শত জিবির পর্ন কালেকশন লুকিয়ে রাখে। এখন তো অনলাইনের নিউজ পোর্টালে খবর পড়তে গেলেও নিস্তার নেই। নিউজ পোর্টালে পর্ন সাইটের এমন কিছু গুগল অ্যাডসেন্সের পক্ষ থেকে দেওয়া বিজ্ঞাপন ভেসে ওঠে যেসব বিজ্ঞাপনের লিঙ্কে ভুল করেও একটা ক্লিক পড়ে গেলে মানুষের সারা রাতে ঘুম হারাম করে দিতে পারে।
পর্ন ইন্ডাস্ট্রির সাথে মানব পাচার ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আধুনিক দাস ব্যবসার পিছনেও রয়েছে পর্ন ইন্ডাস্ট্রির কালো হাত। পর্ন ইন্ডাস্ট্রি দাস ব্যবসায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। ন্যাশনাল হিউম্যান ট্র্যাফিকিং রিসোর্স সেন্টারের দেওয়া তথ্য মতে, পাচার হয়ে যাওয়া তিন ভাগের দুই ভাগ নারীকেই দেহ ব্যবসার কাজে নিয়োগ করা হয়। সারা বিশ্বে এইসব নারীর সংখ্যা হল ২১ মিলিয়ন। যুক্তরাষ্ট্রে সব থেকে বেশী পাচার হয়ে যাওয়া নারীদের পর্ন সাইটে অভিনয় করার প্ররোচনা, পতিতাবৃত্তি, পর্নে অংশগ্রহণ করাতে বলপ্রয়োগ বেশী হয়। এমনকি এইসব পাচার হয়ে যাওয়া নারীদের জোর করে ড্রাগ দেওয়া হয়, তাদের উপর বলপ্রয়োগ প্রচারণা প্ররোচনা প্রভৃতি এমন কোন অপরাধমূলক কাজ নেই যা তারা করে না। সুতরাং যাঁরা বলেন পর্ণ ক্ষতির কিছু নয় তা যে চুড়ান্ত মিথ্যা তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
২০১৬ সালে ব্রিটেনে এঞ্জেলা গ্রেগরি নামে একজন ব্রিটিশ যৌন থেরাপিস্ট বিবিসিকে বলেছিলেন, খুব সহজেই দেখা যায় বলে পুরুষদের মধ্যে যৌন সমস্যার সংখ্যা বাড়ছে। এবিষয়ে চিকিৎসা নিতে তারা ডাক্তারদের দ্বারস্থ হতেন। তিনি হাসপাতালে কাজ করতেন।
ব্রিটিশ একটি দাতব্য সংস্থা তার গবেষণায় বলেছে, ব্রিটেনে যখন ব্রডব্যান্ডের যাত্রা শুরু হলো, ২০০০ সালের দিকে, তখন এই পুরুষদের ২ থেকে ৫% যৌন অক্ষমতার জন্যে পর্নোগ্রাফিকে দায়ী করা হতো। বর্তমানে এই হার প্রায় ৩০%।
এটা শুধু শারীরিক অক্ষমতারই কারণ নয়। যুক্তরাষ্ট্রে গবেষকরা বলছেন, যেসব পুরুষ অল্প বয়সে পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত হয়ে পড়ে তাদের মধ্যে পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্যও গড়ে উঠতে দেখা যায়।
বিবিসির একটি রিপোর্টে সারাহ নাম্নী একজন ২৫ বছর বয়সী যুবতীর অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করা হয়েছে “এখনও সারাহ এসব ভিডিও দেখেন। কিন্তু আগের মতো নয়। কিন্তু তিনি মনে করেন ১০ বছর ধরেও এধরনের ভিডিও নিয়মিত দেখার পর যৌনতার মাধ্যমে চরম তৃপ্তি (অর্গাজম) পাওয়া তার জন্যে খুব কঠিন হয়ে পড়েছে।”
উক্ত রিপোর্টে নীলম নামের একজন যুবতীর মন্তব্য উল্লেখ করা হয়েছে, “আমার মনে হয় পর্নোগ্রাফি মানুষকে অনেক বেশি অসংবেদনশীল করে তোলে। পর্নোগ্রাফিতে অনেক সহিংস দৃশ্যও থাকে এবং একটা সময়ে মনে হয় এসব যেন খুবই স্বাভাবিক।”
নীলমের বয়স যখন ১৬ তখন তিনি পর্নোগ্রাফি দেখা বন্ধ করে দেন। তার কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন শরীরের ওপর এর প্রভাবকেই।
২৮ বছর বয়সী হান্নাও মনে করেন যে খুব বেশি পর্নোগ্রাফি দেখলে মানুষের সংবেদনশীলতা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তবে তিনি বলেছেন, এথেকে তার কিছু লাভও হয়েছে। (সূত্রঃ বিবিসি, ২০ মার্চ ২০১৯/ অনলাইন সংস্করণ)
মানুষ যখন পর্নে আসক্ত হয়ে পড়ে তখন তারা পর্ন ছাড়া থাকতে পারে না। ফলে তারা আরও এক্সট্রিম লেবেলের পর্নের দিকে ঝুঁকে পড়ে এবং তাদের মাঝে পেইড পর্নোগ্রাফী দেখার প্রবণতা বাড়ে এবং তারা প্রিমিয়াম লেবেলের পর্নোগ্রাফী দেখতে শুরু করে এবং এইসব পর্ন আসক্তদের এক একটি ক্লিকে পর্ন ইন্ডাস্ট্রির অসাধু ব্যবসায়ীরা লাভবান হতে থাকে। পর্ন ইন্ডাস্ট্রি তাদের গ্রাহক ধরে রাখার জন্য পর্ন আসক্তিকে আর নির্ভরশীলতাকে বাড়িয়ে আসক্তির অস্বাভাবিক অবস্থাকে তাদের কাজে লাগায় ফলে আসক্তরা তাদের চাহিদাকে পূর্ণ করার জন্য পর্নের প্রতি আরও নির্ভরশীল হয়ে পড়ে এবং এতে পর্ন ইন্ডাস্ট্রির অসাধু ব্যবসায়ীরা আরও লাভবান হয়। শুনলে অবাক লাগবে পর্ন ইন্ডাস্ট্রির মার্কেট এখন প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলারের উপরে। সুতরাং পর্ন হল নিছকই এক ধরণের ব্যবসা যার গ্রাহক হল পর্নে আসক্ত মানুষগুলো। পর্নে যত আসক্তি বাড়বে পর্ন ইন্ডাস্ট্রি তত ফুলে ফেঁপে উঠবে। পর্নে আসক্তি কমে যাওয়া মানেই পর্ন ইন্ডাস্ট্রির অঢেল লোকসান, যা তারা কোন দিনই চাইবে না। তাই তারা যা কিছুই পর্নে দেখায় যা আমাদের স্বাভাবজাত বৈশিষ্ঠের সাথে খাপ খায় না। তারা তাদের ইন্ডাস্ট্রির বৃদ্ধির জন্য যেকোন পন্থা অবলম্বন করবে এবং তাতে ধ্বংস হবে যুবসমাজ।
যুবসমাজে পর্নোগ্রাফীর মারাত্মক প্রভাব নিয়ে বিখ্যাত সাইকোলজিস্ট জর্ডান ফোস্টার বলেছেন, “পর্নোগ্রাফী আসক্তি এমন একটি ভয়াবহ সমস্যা যা অস্ট্রেলিয়ান তরুনদের [এছাড়াও সারা বিশ্বের অন্যান্য তরুণদের জন্যও প্রযোজ্য] মানসিক স্বাস্থ্যে বিরূপ প্রভাব বিস্তার করছে। আধুনিক মানব সমাজ আজ প্রযুক্তিতে পরিপূর্ণ এক বিশ্বে পা রেখেছে, একই সাথে আধুনিক প্রযুক্তি নিয়ে এসেছে যৌনতার বিষয়বস্তুতে পূর্ণ এক বিশাল অন্ধকার জগত, যা কিনা মানুষের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করার চেয়ে অনেক বেশী সহজলভ্য।
অনেক কম বয়সী বাচ্চারা পর্নোগ্রাফী থেকেই যৌনতা সম্পর্কে জানতে পারছে। সমীক্ষার দেখা গেছে, গুগলে বাহ্যিকভাবে খারাপ নয় এমন কিছু খোঁজ করলেও যৌনতা সম্পর্কিত চিত্র বা ইমেজ আমাদের কাছে চলে আসে। অস্ট্রেলিয়ান ছেলেরা গড় ১১ বছর বয়সেই পর্ন খুঁজে পেয়ে যায়। ১৫ বছর বয়স হতে না হতেই ১০০ শতাংশ ছেলে এক্সট্রিম লেবেলের বা হার্ডকোর পর্ন দেখা হয়ে যায়। এখানেই সমাপ্ত নয়, সেইসব তরুনদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিচ্ছে অন্তরঙ্গ সম্পর্কগুলোর প্রতি, হিংস্র এবং অমানবিক যৌন আচরণ দ্বারা স্বাভাবিক যৌন আচরণকে বিকৃতভাবে রুপান্তর করছে। পর্নোগ্রাফীতে দেখানো অস্বাভাবিক দেহগঠনকে ঘিরে তৈরি হচ্ছে অবাস্তব সব চিন্তা যা নিকটবর্তী মানুষগুলোকে ক্রমে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে।”
তিন
পর্ন আসক্তির পরিণতি মানসিক বিকৃতি, বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন, নারীবিদ্বেষী অথবা পুরুষবিদ্বেষীর মত ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে। সমীক্ষায় দেখা গেছে শতকরা ৬৮ জন পুরুষ এবং শতকরা ১৮ জন নারী সপ্তাহে অন্তত একবার পর্ন দেখে। এর আসক্তির পরিমাণ দিন দিন বেড়েই চলেছে। পর্নোগ্রাফী আসক্তি বাড়ার পেছনে যে শুধুমাত্র ইন্টারনেটে এর সহজলভ্যতা নয় বরং পর্নের ক্ষতিকর দিকগুলির প্রতি মানুষের অজ্ঞতাও যথেষ্ট পরিমাণে দায়ী।
এর আগে “পর্নোগ্রাফী মানুষের মস্তিষ্কের উপর যেভাবে ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করে” অধ্যায়ে আমরা দেখেছি যে পর্নে আসক্তির ফলে মানুষ মানসিক বিষন্নতায় ভুগতে পারে। এছাড়াও পর্ন দেখার ফলে মানুষ তিন ধরণের সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে। যেমন,
১। বিষন্নতা
২। মানসিক উদ্বেগ
৩। বিচ্ছিন্নতা
১। বিষন্নতাঃ প্রথমেই আসি বিষন্নতার ব্যাপারে। পর্ন স্বাভাবিক জীবনে বিষন্নতা টেনে আনে। ফলে সেই বিষন্নতাকে দূর করার জন্য আসক্ত ব্যক্তি সাময়িক আনন্দ ও উত্তেজনা ফিরে পাবার জন্য বার বার পর্ন দেখতে থাকে। ফলে এভাবে পর্ন দেখার ফলে তার জীবনে আবার নেমে আসে বিষন্নতা। এভাবে চলতেই থাকে। শেষ পর্যন্ত পর্ন আসক্ত ব্যক্তি মানসিক সুস্থতা হারিয়ে ফেলে। এর আগেই আলোচনা করা হয়েছে যে ড্রাস আসক্তির মত পর্নও একধরণের আসক্তি। পর্ন দেখার ফলে আমাদের মস্তিষ্কে ডেপামিন নিসৃত হয়, যা আনন্দের অনুভূতিগুলো জাগিয়ে তোলে। ফলে অত্যধিক ডেপামিন নির্গত হওয়ার ফলে আগের দেখা পর্নগুলি আর পূর্বের মত আনন্দ জোগাতে পারে না ফলে আসক্ত ব্যক্তি আরও এক্সট্রিম লেবেলের পর্ন দেখতে শুরু করে এবং তাদের এক একটি ক্লিকেই পর্ন ইন্ডাস্ট্রির কোটি কোটি টাকার মুনাফা হয়।
অনেকে শুধুমাত্র বিনোদনের জন্য পর্নোগ্রাফী দেখা শুরু করেন। অব্যক্তিগত জীবনের অশান্তি থেকে মানসিক অবসাদ কাটানোর জন্য পর্ন দেখেন। কিন্তু পর্ন দেখার ফলে মানসিক অবসাদ তো কাটেই না বরং উলটো অবসাদ আরও বেড়ে যায়। ফলে মানুষ প্রকৃত ভালবাসা থেকে দূরে সরে গিয়ে সব ধরণের সম্পর্ক হারিয়ে ফেলে। সুতরাং পর্ন কোন বিনোদনের জিনিস নয় এবং এর থেকে মানসিক অবসাদ দূর হয়না। বরং পর্ন মানুষের জীবনে বিষন্নতা টেনে আনে।
২। মানসিক উদ্বেগঃ পর্নোগ্রাফী আসক্তি মানুষের জীবনে মানসিক উদ্বেগের একটা কারণ হয়ে দাঁড়ায়। পর্নে যেসব যৌনতার দৃশ্য দেখানো হয় তাতে মানুষের মন থেকে লজ্জা জিনিসটাই দূর হয়ে যায় এবং তার মনে বিভিন্ন যৌনতার সাথে সম্পর্কযুক্ত অপরাধবোধের সৃষ্টি হয়। তার মন থেকে আত্মসম্মানবোধ কমে যায়। আর কারো মনে যদি স্বাভাবিকভাবেই লজ্জা, অপরাধবোধ, আত্মসম্মান কম থাকে তাহলে তো কোন কথায় নেই। পর্নোগ্রাফী তাদের মন থেকে এসব একেবারেই শূন্য করে দেবে এবং নৈতিক অধপতন ঘটাবে। ফলে তাদের ব্যক্তিগত জীবনে যেসব সম্পর্কে আবদ্ধ সেই সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে পড়বে, তারা প্রকৃত ভালবাসা থেকে দূরে সরে পড়বে এবং তাদের জীবন হয়ে উঠবে বিষাক্ত।
৩। বিচ্ছিন্নতাঃ পর্নোগ্রাফী মানবজীবনে খুব খারাপ প্রভাব বিস্তার করে থাকে। মানুষ হল সামাজিক প্রাণী। তারা মিলেমিশে না থেকে থাকতে পারেনা। সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ থাকায় মানবজাতীর প্রাচীন বৈশিষ্ঠ। পর্নোগ্রাফী এই মানব বন্ধনকে ছিন্ন করে দেয়। মানুষের মধ্যে যে সৌহার্দ্য না নষ্ট করে দেয়। পর্নে যেসব বিকৃত ও হিংসাত্মক যৌনতার দৃশ্য দেখানো হয় তার সাথে স্বাভাবিক যৌনতার কোন সম্পর্ক নেই। এইসব বিকৃত ও হিংসাত্মক যৌনতার দৃশ্য দেখে পর্ন আসক্তরা স্বাভাবিক যৌনতার যে মাধুর্য সেটা একেবারেই হারিয়ে ফেলে। কারণ বাস্তবে একজন পুরুষ ও মহিলা কেউই পর্নস্টারদের মত পারফর্মমেন্স দেখাতে পারেনা। তাদের দেহ, মন কোনকিছুই পর্নস্টারদের মত নয়। সেজন্য তারা পর্ন দেখে যতটা আনন্দ উপভোগ করে সঙ্গমেও ততটা আনন্দ পায়না। ফলে তারা বিভিন্ন যৌন সমস্যায় ভুগতে থাকে। তাদের যৌন জীবন সুখী না হওয়ার জন্য বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্নের কারণও অনেক সময় কারণ হয়ে দাঁড়ায় এই পর্নোগ্রাফী। তাই আগেও বলেছি যে পর্ন আসক্তি মানুষকে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করে তাদের তাদেরকে জনবিচ্ছিন্ন করে তোলে।
সমীক্ষায় দেখা গেছে আমেরিকায় শতকরা ৫৬টি বিবাহবিচ্ছেদের একটি অন্যতম কারণ হচ্ছে পর্নোগ্রাফি আসক্তি। পর্ন ভিডিওতে যৌন সম্পর্ককে অন্যভাবে দেখানো হয় যা স্বাভাবিক ভালোবাসা ও সম্পর্কের বন্ধন থেকে সম্পূর্ণ আলাদাভাবে উপস্থাপন করে থাকে পর্নের নায়ক নায়িকারা, তাদের যৌনতা বিকৃত যৌনাচারের সন্ধান দেয়; যা আমাদের বাস্তব জীবনের যৌনতার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির। জীব বিজ্ঞানী গ্যারি উইলসন বলেছেন “পর্নোগ্রাফি আমাদেরকে যৌনতার শিক্ষা দেয় না বরং আমাদের যৌন জীবনকে পর্নোগ্রাফি দ্বারা প্রতিস্থাপন করে।”
সুতরাং এককথায়, পর্নোগ্রাফী আমাদের ভালোবাসার পতন ঘটায়, তাই পর্নোগ্রাফি কোনভাবেই স্বাস্থকর কোন কিছু নয়। এটি পুরুষদের যৌন সক্ষমতা নষ্ট করে, মানসিকতা স্বাস্থকে বিপর্যস্ত করে যা দাম্পত্য সম্পর্ক ভাঙ্গন ঘটানোর অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
চার
এখনো সমাজে অনেক এমন ব্যক্তি আছে যাঁরা পর্নোগ্রাফীফে ক্ষতিকর কিছু মনে করেন না, বাস্তবে তাঁরা পর্নোগ্রাফীর ক্ষতি সম্পর্কে সংশয় – সন্দেহের মধ্যে দোদুল্যমান পর্যায়ে রয়েছেন। তাঁদের যুক্তি পর্ন সেই প্রাচীন কাল থেকেই মানুষের মধ্যে ছিল। যেমন গ্রীকদের মাটির আসবাব পত্রে বিভিন্ন যৌন দৃশ্যের চিত্র রয়েছে, প্রাচীন ভারতের অজোন্তা ইলোরা মুর্তিতেও পর্নোগ্রাফীর মতোই বিভিন্ন ভঙ্গিমায় যৌনতার দৃশ্য রয়েছে। অতি প্রাচীনকালের বিভিন্ন গুহাচিত্রে নগ্নতার নিদর্শন পাওয়া গেছে। এছাড়াও দানিয়ুব নদীর তীরে পাথরের উপর খোদাই করা বৃহৎ বুকের অধিকারি এক নারীর ভাস্কর্য পাওয়া গিয়েছিল। এটি প্রায় ২৫,০০০ বছরের প্রাচীন। ভাস্কর্যটির নাম “দ্য ভেনাস অফ উইলেনফোর্ড”। প্রাচীন গ্রীক ও রোমানরা বিভিন্ন ধরণের যৌনতার অজস্র নিদর্শন রেখে গিয়েছেন। পেরুর মোচে সভ্যতায়ও মৃৎশিল্পের উপর যৌন সঙ্গমের চিত্র ফুটিয়ে তোলা হত।
এছাড়াও ভারতের বহু প্রাচীন মন্দিরের মুর্তিতে যৌনতার দৃশ্যে ভরপুর। তাই পর্নোগ্রাফী নতুন কিছু নয়, বহু আগে থেকেই আমাদের সমাজে বিদ্যমান ছিল, তবে অন্যভাবে।
নৃতাত্ত্বিকরা ২০০৫ সালে জার্মান শিকারী-সংগ্রাহকদের একটি পাথরের নির্মিত ভাস্কর্য আবিস্কার করেন, যেখানে নারী-পুরুষের যৌন মিলনের চিত্র খুদিত ছিল। ভাস্কর্যটির বয়স অন্তত ৭,২০০ বছর প্রাচীন। অনেকেই এই ভাস্কর্যটি যে জায়গায় আবিস্কৃত হয়েছে, সেটিকে পৃথিবীর প্রাচীনতম পর্ন সাইট হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
খ্রীস্টপূর্ব ৭৯ অব্দে মাউন্ট ভিসুভিয়াসের অগ্ন্যুৎপাতের কারণে রোমান শহর পম্পেই এবং হারকিউলানিয়াম লাভার নিচে চাপা পড়ে ধ্বংস হয়। অষ্টাদশ শতকে উক্ত নগরগুলো পুনরায় খুঁজে পাওয়া যায়। পম্পেই নগরীর ধ্বংসাবশেষ থেকে শত শত যৌনতা নির্ভর প্রাচীরচিত্র ও ভাস্কর্য খুঁজে পাওয়া যায়।
৯৫০-১০৫০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে চান্দেলা রাজাদের রাজত্বকালে মোট ৮৫টি মন্দিরের প্রথমটির নির্মাণকাজ শুরু করা হয়। রাজশিল্পীদের উদ্যোগে মন্দিরের গায়ে কঠিন পাথর দ্বারা নির্মিত হয় অদ্ভুত সব কারুকাজ- যার মধ্যে বেশিরভাগটাই হিন্দু দেবদেবীদের যৌন মিলন মুহূর্তের ছবি। মন্দিরের দেওয়ালে খোদিত যৌনতার মুহূর্তের নগ্ন ভাস্কর্যের জন্যেই মন্দিরগুলো খুবই জনপ্রিয়। এসকল ভাস্কর্যে বেদজ্ঞ পণ্ডিত বাৎস্যায়নের কামসূত্রকে অনুসরণ করা হয়েছে। ঐতিহাসিকদের মতে তিনি গুপ্তযুগে চতুর্থ থেকে ষষ্ঠ শতাব্দী ভারতবর্ষে ছিলেন। যদিও ভারতীয়দের কাছে মন্দিরে প্রদর্শিত নগ্ন দেবদেবীর মূর্তিগুলো ধর্মীয়, পবিত্র সম্পদ হিসেবে বিবেচিত, তবুও যখন উনিশ শতকের শুরুতে ইউরোপিয় পণ্ডিতরা ভারতবর্ষে আসতে শুরু করেন, তাঁরা খাজুরাহোর নগ্ন ভাস্কর্যগুলোকে প্রাচীন পর্নোগ্রাফির নিদর্শন হিসেবে অভিহিত করেন।
এখানে একটা প্রশ্ন থেকে যায়, প্রাচীন মানব সমাজে স্থির কোন মূর্তিতে যৌনতার দৃশ্য আর বর্তমানে ইন্টারনেটের সার্ভারে আপলোড থাকা উন্নত পিক্সেলের হাই রেজুলেশন পর্ন ভিডিওর তুলনা কতটা যুক্তি সঙ্গত সেটা ভাববার বিষয়। আমার মতে, তৎকালীন কোন মন্দিরের মূর্তিগুলোর যৌনতার দৃশ্যের সাথে বর্তমানের পর্নোগ্রাফীর সাথে কোন তুলনায় হয়না কারণ মুর্তিগুলি স্থাপত্য সেগুলো দেখার জন্য বহু দূর দুরান্ত থেকে মানুষকে যেতে হত কিন্তু বর্তমানে মোবাইলের মত একটা ছোট্ট ডিভাইসের মাধ্যমেই যে কোন মুহুর্তে যে কোন স্থানে পর্নোগ্রাফীর বিষাদময় স্বাদ উপভোগ করা যায়। বর্তমান প্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে শুধুমাত্র পর্নের বিষয়বস্তুই নয় বরং পর্ন দেখার বয়স, সময়, পরিমান, পদ্ধতি সবকিছুতেই বিপুল পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
No comments: